হাত বাড়ালেই বন্ধু (গল্প )

আজও মনে হয় কলেজ যাওয়া হলো না পারমিতার। আজ তিন দিন হল ছবিদি আসছে না। তাই পারমিতাও কলেজ যেতে পারছে না। তাতান কে কার কাছে রাখবে? তাতানের বয়স পাঁচ। পারমিতা আর অতনুর একমাত্র  সন্তান।

হাত বাড়ালেই বন্ধু (গল্প )
হাত বাড়ালেই বন্ধু (গল্প ), story bangla, bangla story new

হাত বাড়ালেই বন্ধু (গল্প )

আজও মনে হয় কলেজ যাওয়া হলো না পারমিতার। আজ তিন দিন হল ছবিদি আসছে না। তাই পারমিতাও কলেজ যেতে পারছে না। তাতান কে কার কাছে রাখবে? তাতানের বয়স পাঁচ। পারমিতা আর অতনুর একমাত্র  সন্তান। এই কলকাতা শহরে আত্মীয়-পরিজন বলতে তার তো কেউই নেই। তার বাবা মা বোন সকলেই থাকে বাঁকুড়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। আত্মীয় পরিজন বেশিরভাগই ওখানেই কাছাকাছি থাকে। আর শাশুড়ি মা থাকেন বর্ধমানে। একাই থাকেন। শ্বশুরমশাই মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর। পারমিতা শাশুড়িমাকে অনুরোধ করেছিলেন কলকাতায় ফ্ল্যাটে তাদের সাথে থাকার জন্য কিন্তু তার শাশুড়িমা কিছুতেই রাজি হন নি। বিয়ের পর থেকে তার শাশুড়ি মাকে কখনোই খারাপ মনে হয় নি। যথেষ্ট ব্যক্তিত্বময়ী, কথাবার্তাও বেশ ভালো। কখনো পারমিতার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার তিনি করেন নি। নিয়মিত বইপত্র পড়েন, খবরে কাগজ পড়েন, গান শোনেন। নিজের মতো করেই থাকেন বর্ধমানে। মাঝেমধ্যে ফোন করে সকলের খবর নেন এই পর্যন্তই। শাশুড়ি সাথে থাকলে তাকে এভাবে কলেজ কামাই করে বাড়ীতে বসে থাকতে হতো না। এইতো বছর দুই হল কলেজের চাকরিটা পেয়েছে সে। মাঝে মাঝে একটু অভিমান হয় তার শাশুড়ি মায়ের ওপরে। কিন্তু কি আর করবে, জোর তো  করা যায় না। কাল কলেজে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল। অতনুকে বলেছিল কালকের দিনটা যদি ছুটি নিয়ে তাতানের কাছে একটু থাকে। কিন্তু সেই নিয়েই শুরু হয় ভীষন অশান্তি আর তারপর.......
ভাবতে ভাবতেই কলিং বেল বাজল। পারমিতা খুলে দেখল ছবিদি এসেছে। চোখ মুখ শুকনো,অনেক জায়গায় কালসিটের দাগ।
কি গো ছবিদি তিন দিন আস নি কেন? তোমার জন্য আমি কলেজেও যেতে পারছি না। কি বলব গো বৌদি? রোজ রোজ আমার বর রাত্রে মদ খেয়ে এসে মার ধোর করে। যা টাকা পয়সা পাই তার বেশিরভাগ  জোর করে কেড়ে নেয়। রোজকার এই অশান্তি সহ্য করতে না পেরে তাই সব ছেড়ে দিয়ে কাল মেয়েটাকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে এসেছি। আমি যা মাইনে পাই তাতে আমাদের দুজনের পেট চলে যাবে গো বৌদি। তুমি চিন্তা করো না, আর কামাই হবে না গো। তুমি এবার নিশ্চিন্তে কলেজ যাও। তাতানকে আমি দেখছি।
কথাগুলো শুনে পারমিতা একটু চুপ করে গেল। সেই দেখে ছবিদি  জিজ্ঞাসা করল "কি গো বৌদি আমি কি কিছু ভুল করেছি? আমি একলা মেয়েটাকে বড়  করতে পারবো না? তুমি তো জানো বৌদি আমার মেয়েটা পড়াশোনায় বেশ ভালো। এবার পারমিতা তার অন্যমনস্কতা কাটিয়ে বলল "না না ছবিদি তুমি ঠিকই করেছো। কেন মেয়েকে বড় করতে পারবে না একলা? ঠিক পারবে।"
"হ্যাঁ গো বৌদি বস্তির লোকজন আমাকে তাই বলেছে। এরপর ছবিদি পারমিতার দিকে তাকিয়ে বলল "কিন্তু বৌদি তোমাকে এতো শুকনো লাগছে কেন? একা হাতে সব করতে হচ্ছে তো তাই। আমি তো জানি দাদাবাবু তো আবার ঘরের কোন কাজই করতে পারে না।
পারমিতা একটু হেসে বলল "না না ঠিকই আছে ও এমনি।" বলে সে কলেজের জন্য রেডি হতে লাগল। যাবার আগে তাতানকে একটু আদর করে ছবিদিকে সব বুঝিয়ে বেরোতে যাবে হঠাৎই ছবিদি জিজ্ঞাসা করলো "বৌদি হাতঘড়িটা নতুন কিনেছ? খুব ভালো দেখতে।"
এবার পারমিতা একটু মৃদু স্বরে বলল "না গো আগেরই কেনা। একটু চওড়া ব্যান্ড তাই পড়তাম না। আজ ব্যান্ডটা  শাড়ির রঙের সাথে মিলে গেল তাই পড়লাম। আমি বেরোলাম ছবিদি তুমি দরজাটা বন্ধ করে নাও।"
বাসে চড়ে পারমিতা ভাবছে কেন ছবিদিকে সত্যি কথাটা বলে উঠতে পারল না সে। আসলে সেও যে তার হাতের অতনুর  সিগারেটের ছ্যাকা দেওয়া পোড়া দাগটা ঢাকতেই এই ঘড়িটা পড়েছে।আসলে তার সঙ্গে ছবিদির খুব একটা বেশি পার্থক্য নেই। গার্হস্থ হিংসার শিকার সেও।তার  
শিক্ষিত, সুচাকুরে স্বামীর সঙ্গে যখন কোন বিষয়ে মতবিরোধ হয় তখন তার শিক্ষার আচ্ছাদনটা খসে গিয়ে বেরিয়ে আসে আদি ভাষা,ক্ষমতার আস্ফালন, আগ্রাসন এবং মাঝে মাঝে শারীরিক অত্যাচার। আসলে তার স্বামী বাইরে যে ভাষাটা ব্যবহার করে সেটা শিক্ষিত ভাষা, কিছুটা প্রচেষ্টা মূলক ভাষা আর অশান্তির সময় সাবলীলভাবে যে ভাষাটা বেরিয়ে আসে সেটা পিতৃতন্ত্রের ভাষা। আসলে নারীবিদ্বেষ বোধহয় ঐতিহাসিকভাবেই এতটাই মজ্জাগত, এতটাই সহজাত,যে প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মত যেকোনো পারিবারিক বিরোধে পুরুষ সেই নারীবিদ্বেষী ভাষাই ব্যবহার করে থাকে।  
তবুও অশিক্ষিত ছবিদি যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে শিক্ষিতা পারমিতা সে সিদ্ধান্তটা এখনো নিতে পারেনি। সোসিওলজির অধ্যাপিকা পারমিতা, ভালো ছাত্রী পারমিতা প্রায়ই তার স্বামীর কাছে লাঞ্ছিত হয়, নির্যাতিত হয়, অত্যাচারিত হয়, এই ক্ষতটা জনসমক্ষে আনার সাহস করতে পারে নি। বাড়িতে বাবা অসুস্থ, ছোট বোন এখনো পড়াশোনা করছে তারও বিয়ে বাকি। তার ছাত্র-ছাত্রী সহকর্মীরা কি ভাববে। তাতানকেও তার বাবার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা, লোকে কি বলবে, এই স্বজনবিহীন শহরে তাতানকে নিয়ে থাকতে পারবে কিনা সে সিদ্ধান্তটা নিয়ে উঠতে পারে নি। তবে আজ ছবিদি বোধহয় তাকে একটা শিক্ষা দিল। তার শিক্ষার দিকে তার সামাজিক অবস্থানের দিকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল। 
আসলে কলকাতা ইউনিভার্সিটি তে পড়ার সময় প্রথম পরিচয় হয় অতনুর সাথে পারমিতার। ধীরে ধীরে তৈরী হয় বন্ধুত্ব, বাড়ে নির্ভরতাও। এরপর বিয়ে । দুই বাড়ির কোন বাড়ি থেকেই কোন আপত্তি আসে নি। সকলের আশীর্বাদ নিয়েই বিয়ে হয়েছিল তাদের। তারপর থেকে পারমিতা একটু একটু করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বরাবরই শান্ত স্বভাবের মেয়ে পারমিতা। কিন্তু পারমিতার চাকরি পাওয়ার পর থেকেই অশান্তি চরমে উঠেছে। পারমিতা কে তার সমকক্ষে বসাতে বোধহয় অতনুর কোথাও পৌরষত্বে আঘাত লাগছে।
কিন্তু সত্যিই ছবিদি আজ তার চোখ খুলে দিয়েছে এবার বোধহয় সময় তার ঘুরে দাঁড়ানোর। তাতান কে নিয়ে আলাদা থাকাটাই বোধহয় তার উচিত এবার। কলেজ থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরে এলো পারমিতা। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে আজ।তাতান এখনো ঘুমোচ্ছে। অতনুর ফিরতে এখনো অনেক দেরি। হঠাৎ শাশুড়ি মায়ের ফোন এলো। 
উনি ওনার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলেন "কেমন আছে ? তাতান কেমন আছে?"
তবে আজ পারমিতা তার বাধা গতের উত্তর,এই চলে যাচ্ছে না বলে বরং প্রথম সে তার শাশুড়ি মায়ের কাছে  স্বীকার করে বলল 
----'মা আমি ভালো নেই।'
এবার পরমার শাশুড়িমা অবাক করে দিয়ে বললেন 
----‐জানি তুমি ভালো নেই। ভালো থাকার তো কথাও নয়। তোমার মত শান্তস্বভাবের শিক্ষিতা একটা ভালো মেয়ের আমার ছেলের সাথে ভালো থাকার কথা নয়।
----- আপনি সব জানেন মা?
----‐ সবটা হয়তো জানি না। তবে অনুমান করতে পারি। তাতানের সাথেও আমার মাঝে মধ্যে কথা হয়। ও বলেছে মা মাঝেমধ্যে কান্নাকাটি করে। বাবা খুব জোরে জোরে কথা বলে। কিন্তু পারমিতা আমার না হয় অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল না আমি প্রতিবাদ করতে পারিনি, বেরিয়ে যেতে পারিনি কিন্তু তুমিতো ভালো চাকরি করো অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম তাহলে কেন  সহ্য করছ? শুধুমাত্র লোকলজ্জার ভয়ে, লোকে কি বলবে তাই জন্য?
-----মা আপনিও?
----- হ্যাঁ পারমিতা সেজন্যই তো আমি তোমার কষ্টটা বুঝতে পারছি। বিয়ের পর থেকেই আমিও লাঞ্ছনা, নির্যাতন সহ্য করেছি। আর ফিরে যাওয়ার কোন পথ আমার ছিল না। চার বোন, চার ভাই। বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে, ভাইদের বিয়ে হয়ে গেছে। কার কাছে ফিরবো বল? অতনু এই অত্যাচার, লাঞ্ছনা দেখে বড় হয়েছে আর বংশের একমাত্র প্রদীপ, একমাত্র সন্তান বলে দাদু ঠাকুমা কাকা, কাকিমা সবার কাছ থেকেই প্রশ্রয় পেয়ে বড় হয়েছে। এই সংসারে যে সে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এটা জেনেই সে বড় হয়েছে। বড় হয়েছে কিন্তু মানুষ হয় নি। ওর বদমেজাজ, আত্ম অহংকার  মানুষকে অপমান করা, ওর স্বভাব। আমার সন্তানকে আমি মানুষ করতে পারি নি। এ লজ্জা বড় দুঃসহ।তাই তোমার অনেক অনুরোধ সত্বেও আমি তোমাদের কাছে গিয়ে থাকি নি। কিন্তু পারমিতা, আমার না হয় কোন উপায় ছিল না তোমার তো সে উপায় আছে। মনে রেখো পারমিতা, শক্তি সেটা নয় যেটা তোমার শরীর থেকে আসে, শক্তি সেটাই যেটা তোমার হৃদয় থেকে আসে। মনটাকে শক্ত করো একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নাও। আমি চাই না তাতান আর একটা অতনু তৈরি হোক। তবে আমি তো তোমাকে জোর করতে পারিনা শুধু তোমার পাশে থাকতে পারি। শুধুমাত্র তোমার শাশুড়ি মা হিসেবে নয়, একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে।
------- হ্যাঁ মা আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাতাকে নিয়ে আমি একাই থাকবো।
------- একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছো। আমি তোমাকে এক্ষুনি ডিভোর্স বা সেপারেশন নিতে বলছি না। কিন্তু তুমি আলাদা থেকে অতনুকে বুঝিয়ে দাও যে তুমিও একলা থাকতে সক্ষম। ওকে শুধু বুঝিয়ে দাও যে তলোয়ার দিয়ে ও তোমাকে বিদ্ধ করছে সেই তলোয়ারের একটা দিক কিন্তু একদিন ওকেও বিদ্ধ করবে। আর শোনো, কোন একটা সম্পর্ক ভেঙেছে বলেই মেয়েটা খারাপ বা মেয়েটা সংসার করতে পারে না এমনটা নয়। হতেই পারে উল্টোদিকের মানুষটা ঠিক ছিল না। প্রত্যেকটা মানুষের ভালোভাবে বাঁচার অধিকার আছে। তুমি একা আছো মানে তুমি সকলের করুনার পাত্রী এমনটাও কিন্তু নয়। আজকের দিনে দাঁড়িয়েও কেন একটা মেয়ের বিচার করা হবে তার ম্যারিটাল স্ট্যাটাস দেখে? অনেকেই আমরা ভুলে যাই যে স্বামী স্ত্রীর মিলিত জীবনের পরিপূর্ণতাও প্রয়াসের অপেক্ষা রাখে। বিবাহ সে পরিপূর্ণতার লাইফ ইনসিওরেন্স নয়, গ্যারান্টি তো নয়ই। আমার আজও ভাবতে অবাক লাগে যে কোন নায়িকা, গায়িকা বা যে কোন সেলিব্রিটি মহিলাদের যখন বিয়ে  ভেঙে যায় বা একাধিকবার বিয়ে হয় তখন তাদের নিয়ে সমালোচনা হয়, হাসাহাসি হয়, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কিন্তু যখন কোন নায়ক গায়ক একাধিকবার বিবাহ করেন সেটা তোমাদের প্রজন্মেই হোক বা আমাদের প্রজন্মের কোনো সমালোচনা কিন্তু তাদেরকে নিয়ে হয় না।
------- হ্যাঁ মা আমি কাল থেকেই একটা ছোট বাড়ি বা ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করব। কিন্তু কথা হলো যে  একা মহিলাকে ছোট সন্তান নিয়ে কেউ ভাড়া দিতে রাজি হবেন কিনা?
------- একা তো তুমি নও পারমিতা আমি যে বললাম আমি তোমার সাথে আছি। আমি থাকবো তোমার সাথে। বোল, আমার শাশুড়ি মা আমি আমার সন্তানকে নিয়ে থাকবো। যদি কেউ বাড়ি ভাড়া না দেয় তাহলে একটা ছোট ফ্ল্যাট কেনার ব্যবস্থা করো। টাকা যদি দরকার লাগে আমি দেব। কিছু জমানো টাকা আছে আমার। এখানে সম্পত্তিও আছে, দরকার হলে আমি সেসব বিক্রি করে দেব।
-----মা আপনি একই শহরে নিজের ছেলের সাথে না থেকে আমার সাথে থাকবেন?
--------আমি নিজের ছেলে পরের মেয়ে বুঝি না। যে ঠিক আমি তার সাথেই থাকবো। আসলে তোমার সাথে থাকাটা তো শুধু থাকা নয়। তোমার সিদ্ধান্তটা কে সম্মান জানানো, সমর্থন করা হলো আমার মুল উদ্দেশ্য। আর এই সমাজকে বুঝিয়ে দেওয়া যে দোষটা তোমার নয়,দোষটা আমার সন্তানের। তারপর আমরা দুজন না হয় অপেক্ষা করবো। অতনুর একদিন পরিবর্তন হবে। সে আমাদের কাছে একজন  ভালো মানুষ হিসেবে ফিরে আসবে। সে তার ভুল বুঝতে পারবে।
পারমিতা ভাবছে তার প্রাপ্তির ভাড়ারটা তাহলে একদম শূন্য নয়।এমন শাশুড়িমাই বা কয় জন মেয়ে পায়।

লেখিকাঃ______সুস্মিতা রায়চৌধুরী