রাঙিয়ে দিয়ে যাও ( গল্প )

জানলার গ্রিলটা শক্ত করে ধরে বাইরের দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে আছে রাই। কষ্টটা যেন গলার কাছে দলা পাকিয়ে জমে আছে।আজ দুবছর হয়ে গেলো তাও যে কেন নিজেকে সংবরণ করতে পারে না রাই,সে নিজেই বোঝে না।মিঠি তো একটা পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে।শোক,দুঃখের ও কি   বা বোঝে।

রাঙিয়ে দিয়ে যাও ( গল্প )
রাঙিয়ে দিয়ে যাও ( গল্প ), story bangla, bangla story new

রাঙিয়ে দিয়ে যাও ( গল্প )

জানলার গ্রিলটা শক্ত করে ধরে বাইরের দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে আছে রাই। কষ্টটা যেন গলার কাছে দলা পাকিয়ে জমে আছে।আজ দুবছর হয়ে গেলো তাও যে কেন নিজেকে সংবরণ করতে পারে না রাই,সে নিজেই বোঝে না।মিঠি তো একটা পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে।শোক,দুঃখের ও কি   বা বোঝে।
কালকে দোল।তাই মিঠি বায়না করছিল রাইকে নিয়ে বাজারে যাবে।রং,পিচকারি, আবির এসব কিনতে।কিন্তু রাই মিঠিকে জোরে ধমক দিয়ে বলে "কোন কিছু কেনার দরকার নেই।দোল খেলতে হবে না।" রাইয়ের চিৎকার শুনে ছুটে আসে ওর শ্বশুর,শাশুড়ি। মিঠিকে ভুলিয়ে রাইয়ের শ্বশুরমশাই মানিকবাবু মিঠিকে নিয়ে বাজার চলে যায়।
এই একরত্তি মেয়ে মিঠিকে কি করে বোঝায়  রাই,যে দোলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার অনেক স্মৃতি।আজও মনের মনিকোঠায় জ্বলজ্বল করছে সে সব স্মৃতিরা।লাল আবির দেখলে যে বুকটা টনটন করে ওঠে রাইয়ের।লাল আবির যে বড় পছন্দের ছিল অনুপমের।আর শুধু লাল আবির কেন,লাল রঙটাই খুব পছন্দের ছিল অনুপমের।
বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল তবুও রাইয়ের মনে হয় এইতো সেদিনের কথা।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে তখন রাই।বন্ধুরা সবাই মিলে যাচ্ছিল শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব দেখতে।ট্রেনে অনুপমের সাথে পরিচয় হয়েছিল।অনুপমও বসন্ত উৎসব দেখতে যাচ্ছিল ওর বন্ধুদের সাথে।
তারপর আবার দেখা হল শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব প্রাঙ্গণে।ভ্রমরের গুঞ্জনে, কোকিলের কুহুতানে,পলাশের রঙে প্রকৃতি সেদিন অপরূপা।প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকেও সাজিয়েছিল রাই। শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের মূলমন্ত্রই হল "ভুলিয়ো আপন পর ভুলিয়ো।" আপন পর ভুলিয়া উপস্থিত সকলে মেতে ওঠে রঙের উৎসবে।মানবতার এমন নিদর্শন বোধহয় খুব কমই দেখা যায়।
তাই শুধু বহিরঙ্গে নয়,রাইয়ের মর্ম সেদিন রঞ্জিত হয়েছিল অনুপমের দেওয়া লাল আবিরে।বাতাসে ভাসছে তখন গানের সুর 
"আকাশে বহিছে প্রেম,নয়নে লাগিল নেশা কারা যে ডাকিলো পিছে!বসন্ত এসে গেছে।"
হ্যাঁ।সেদিন সত্যিই রাইয়ের জীবনে এসেছিল বসন্ত।তাই লাল আবির থেকে লাল সিঁদুরের যাত্রাপথ খুব সহজেই পেরিয়ে গিয়েছিল তারা।
"পলাশের নেশা মাখি চলেছি দু'জনে বাসনার  রঙে মিশিয়ে শ্যামলে স্বপনে"
সুখে ভরে উঠেছিল তাদের বিবাহিত জীবন। অনুপম চাকরি করতো আর্মির ইনফেন্ট্রি রেজিমেন্টে।পোস্টিং ছিল বর্ডারে।বেশ কয়েকবছর সুখেই কেটেছিল তাদের জীবন। মিঠি এসেছিল তাদের জীবনে।কিন্তু মিঠির যখন তিন বছর বয়স হঠাৎই তাদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার।বর্ডারে শত্রু পক্ষের সঙ্গে গুলি বিনিময়ের সময় নিজের সহযোদ্ধাকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারায় অনুপম।
শোকে-দুঃখে রাই একেবারে পাথর হয়ে গিয়েছিল।বেঁচে থাকার ইচ্ছেটুকু পর্যন্ত চলে গিয়েছিল।একই অবস্থা হয়েছিল অনুপমের বাবা,মানিকবাবুর এবং মা সীমাদেবীর। মিঠির তখন বোঝার মত বয়সই হয় নি।এই সময় ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল অনুপমের বন্ধু এবং মানিকবাবুর ছাত্র পলাশ।মানিকবাবু পেশায় ছিলেন গণিতের শিক্ষক।
সবাই যখন শোকে মুহ্যমান তখন মিঠিকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিজেই পলাশ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল।ছুটির দিনগুলোতে মিঠিকে পার্কে নিয়ে যাওয়া,দু একদিন অন্তর এসে মিঠির সঙ্গে গল্প করা,খুশি হয়েই এসব করতো পলাশ।কিছুদিনের মধ্যেই মিঠির সঙ্গে এক অদ্ভুত মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে গেল পলাশ।আসলে মিঠির হাত ধরে পলাশও ফিরে যায় তার ছোটবেলায়।খুব ছোটবেলায় সেও বাবাকে হারিয়েছিল।তাই মিঠির কষ্টটা সে বোঝে।এখন তো পলাশ একদিন না আসলেই মিঠির মন খারাপ হয়ে যায়। 
অনুপমের বন্ধু হওয়ার সূত্রে এবং মানিকবাবুর ছাত্র হওয়ার জন্য এ বাড়িতে পলাশের যাতায়াত তো ছিলই।বন্ধুপত্নী হওয়ার সূত্রে রাইয়ের সাথেও ছিল একটা হাল্কা বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
কিন্তু অনুপমের মৃত্যুর পর থেকে রাই কথাবার্তা বলা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে।শুধু দু-একটা প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া কিছুই বলে না সে।জগতের সমস্ত পার্থিব সুখ,আনন্দ সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে।আলমারিতে থাকা সমস্ত লাল শাড়ি,লাল জামা কাপড় সরিয়ে ফেলেছে।প্রসাধন তো দূরের কথা নিজের চুলটুকু পর্যন্ত ভাল করে আচরায় না।
পলাশ এবং মানিকবাবু দুজনেই বুঝতে পেরেছিল যে মিঠিকে ভালো রাখার জন্য রাইয়ের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাটা খুব জরুরী।
মানিকবাবু প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে  পলাশকে বাড়িতে ডাকতেন।একদিন জোর করেই ওদের দুজনকে বললেন মিঠিকে সঙ্গে নিয়ে চিড়িয়াখানা ঘুরে আসতে।মানিক বাবুকে বরাবরই খুব শ্রদ্ধা করে রাই।তাই শ্বশুরমশাইয়ের কথা ফেলতে পারল না,গেল  চিড়িয়াখানায়।মিঠির তো আনন্দের সীমা, পরিসীমা নেই।পলাশের হাত ধরে দৌড়ে বেড়াচ্ছে আর বকবক করছে।রাইযেরও খুব একটা খারাপ লাগলো না।দাড়িয়ে রইলো পাখির খাঁচার সামনে অনেকক্ষণ।একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পাখিগুলোর দিকে।আবার দাঁড়ালো কিছুক্ষণ জিরাফের খাঁচার সামনে।জিরাফ গুলো গলা উঁচু করে গাছের পাতা খাচ্ছে।প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিল রাই আজকে।সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির মধ্যে কতই না বৈচিত্র্য।
ফেরার পথে রাই পলাশকে বলল "সত্যি, আপনি আমাদের জন্য অনেক করলেন। আপনি না থাকলে কি করে যে মিঠিকে সামলাতাম।" 
এবার পলাশ বলল "শুধুই কি করেছি, বিনিময়ে কি পাইনি কিছুই?"
রাই কোন উত্তর না দিয়ে শুধু চুপ করে রইলো।
মানিকবাবু এবং সীমাদেবী অবশ্য তাদের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দৃষ্টি দিয়ে অনেকদিন আগেই বুঝে ফেলেছিলেন পলাশের মনের কথা।
অবশ্য তারাও এমনটাই চাইছিলেন। মেয়েটার জীবন যে বড়ই বেরঙিন হয়ে গেছে অনুপমের চলে যাওয়ার পর থেকে।বিজয়া  দশমীর দিন যখন মাকে বরণ করে সিঁদুরে মাখামাখি হয়ে পাড়ার মেয়ে বউরা ফেরে, তখন তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের অজান্তেই রাইয়ের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।সামাজিক কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে রাই।কারন এইসব অনুষ্ঠানের মাঙ্গলিক কাজে সমাজ টেনে দিয়েছে সধবা এবং বিধবাদের মধ্যে সীমারেখা।
মানিকবাবু বুঝে গিয়েছিলেন যে পলাশ হলো সেই ছেলে যার ওপর ভরসা করা যায়।কিন্তু রাই এখনো তার মনকে দুঃখের চাদরেই ঢেকে রেখেছে।অনেক চেষ্টা করেও পলাশ কোনভাবেই রাইয়ের মনের দুঃখের চাদর সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে পারছে না।
মিঠি আনন্দে নাচতে নাচতে দাদুর সঙ্গে আবির,রঙ,পিচকারী,বেলুন সব নিয়ে ঢুকলো।কাল দোল।মিঠি খুব খুশি।
দোলের দিন সকালে পলাশ লাল রঙের আবির নিয়ে এল।বেশ কয়েক দিন হল এ বাড়িতে আসেনি পলাশ।অস্থির হয়ে ছিল মিঠি।পলাশকে দেখেই দৌড়ে গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো।পলাশ একটু লাল রঙের আবির নিয়ে মিঠির দুই গালে লাগিয়ে দিল। তারপর মানিকবাবু আর সীমাদেবীর পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করে বলল"স্যার,পরের বছর হয়তো দোলের সময় কলকাতায় থাকবো না।অফিসে বদলির জন্য দরখাস্ত করেছিলাম বোধহয় সামনের মাসেই দিল্লিতে পোস্টিং পেয়ে যাব।"
মানিকবাবুর বুঝতে বাকি রইলো না যে  রাইয়ের তার প্রতি এই কঠিন এবং উদাসীন আচরণের জন্যই পলাশ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।কিন্তু মানিকবাবু মনে মনে ঠিক করলেন তিনি এটা কিছুতেই হতে দেবেন না।
মিঠি হঠাৎ করে বলল "কাকু,তুমি দাদু, ঠাম্মি আমাকে সকলকে আবির দিলে মাকে দিলে না কেন?মাকেও আবির লাগিয়ে দাও।"
এবার রাই বলল "মিঠি,তুমি এখন ছোট,তুমি বুঝবে না।তুমি বরং কাকুর সাথে বাইরে গিয়ে রং খেলো।"
এবার মানিক বাবু বললেন "মিঠি,না হয় ছোট,সে বোঝেনা।কিন্তু তুমিও কি বোঝো  না? তোমার কি রং খেলা বারণ?
তুমি একজন বীর শহীদের স্ত্রী।আমার সন্তান যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেছে।মৃত্যু সতত দুঃখের।কিন্তু এই মৃত্যু যে সম্মানেরও, গর্বেরও।আমার সন্তান দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে।একজন নারী তার স্বামীকে যুদ্ধক্ষেত্রে হারিয়েও তার সন্তানকে আবার তৈরি করে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর জন্য আর তুমি নিজেই জীবন যুদ্ধ থেকে সরে যাচ্ছো।নিজেকে জগৎ সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে চাইছো?তাহলে তুমি মিঠিকে বড় করবে কিভাবে?একজন সৈনিকের স্ত্রীকেও জীবনে অনেক লড়াই করতে হয়।জীবনের মূল স্রোতে ফিরে এসো।অনুপম চলে গেছে ঠিকই কিন্তু পলাশকে ঝরে যেতে দিওনা অনাদরে।নতুন করে বাঁচো আবার,নতুন করে স্বপ্ন দেখো। অনুপম তাতেই খুশি হবে।"
তারপর পলাশের দিকে তাকিয়ে মানিকবাবু বললেন "আর পলাশ,আমি চাই তুমি চাকরির এই বদলির সিদ্ধান্তটা বদলাও। আর যদি তুমি একান্তই যেতে চাও,তাহলে মিঠি এবং রাইকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। আর সে ব্যবস্থা আমি নিজে করব।"
এবার রাই বলল "বাবা,আমি অনুপমকে কখনো ভুলতে পারবো না।"
"ভুলতে তো তোমায় আমি বলছি না রাই।সেটা সম্ভব নয় আমি জানি।অনুপমকে মনে রেখেও পলাশের সাথে নতুনভাবে জীবন শুরু করা যায়।একজনকে আপন করতে গেলে আরেক জনকে যে ভুলতে হবে এমন তো কোন মানে নেই।এইতো আমার কাছে স্কুল-কলেজের অনেক ছাত্র-ছাত্রী পড়তে এসেছে।তাদের সেই কিশোরবেলার প্রেম আমি দেখেছি।কিন্তু তারপর হয়তো অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যে যার আলাদা সংসার করেছে।তারা কি সবাই ভুলে গেছে? না কি তারা কেউ সুখী নয়?"
তারপর পলাশের দিকে তাকিয়ে মানিকবাবু বললেন "যাও পলাশ,রাইকে লাল আবির  ছুঁইয়ে দাও।ফিরিয়ে নিয়ে এসো ওকে জীবনের মূল স্রোতে।কারণ এই উৎসবের মধ্যে দিয়েই আমরা খুঁজে নিই ক্ষতের বিশল্যকরণী।আমি মিঠিকে নিয়ে একটু বাইরে যাচ্ছি রঙ খেলতে।তোমরাও এসো।"
এবার পলাশ এগিয়ে এসে রাইয়ের কপালে ছোঁয়ালো লাল আবির।কেঁপে উঠল রাইয়ের সমস্ত শরীর,মন।চৈত্রের খর দহে আর শোকের আগুনে পুড়ে গেছে রাই এর সমস্ত মন।রাই এর চোখের জল গাল বেয়ে চিবুক ছুঁতেই সেই চোখের জল হাতে নিয়ে পলাশ বলল "আজ থেকে তোমার যন্ত্রণা,ব্যথার ভাগ আমাকে দিয়ে হালকা হও রাই।"
তখনই সামনের একটি স্কুলে অনুষ্ঠিত বসন্ত উৎসব থেকে গান ভেসে এলো
"রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে 
রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও এবার যাবার আগে
তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে, তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে অশ্রুজলের করুণ রাগে।
রাঙিয়ে দিয়ে যাও…….

লেখিকাঃ______সুস্মিতা রায়চৌধুরী