চারুলতা ( গল্প )

মিসেস তপতী মুখার্জী আজ খুব খুশি। তিনি আজ গৌরবের গৌরবে গৌরবান্বিতা।তার একমাত্র সন্তান, গৌরব,বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাস করে একটা বড় আই টি কোম্পানিতে চাকরি করার কিছুদিনের মধ্যেই নিউটাউনে একটি বিলাসবহুল তিন কামরার ফ্ল্যাট কিনেছে।আজ সেই ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশ।গৌরব ফ্ল্যাটের নাম রেখেছে চারুলতা।

চারুলতা ( গল্প )
চারুলতা ( গল্প ), story bangla, bangla story new

চারুলতা ( গল্প )

মিসেস তপতী মুখার্জী আজ খুব খুশি। তিনি আজ গৌরবের গৌরবে গৌরবান্বিতা।তার একমাত্র সন্তান, গৌরব,বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাস করে একটা বড় আই টি কোম্পানিতে চাকরি করার কিছুদিনের মধ্যেই নিউটাউনে একটি বিলাসবহুল তিন কামরার ফ্ল্যাট কিনেছে।আজ সেই ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশ।গৌরব ফ্ল্যাটের নাম রেখেছে চারুলতা।গৌরবের ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠানে মিসেস মুখার্জী,তার বান্ধবীদের এবং আত্মীয় পরিজনকে ডেকেছেন তার ছেলের সাফল্যকে তুলে ধরার জন্যই।ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠানে তিনি দেখাতে চান তিনি ছেলেকে কত ভালো মানুষ করেছেন।তিনি গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠানে তার বান্ধবীদের জানালেন একমাস পরে তার ছেলের বিবাহ হবে এই ফ্ল্যাট থেকেই এবং তারপর তারা সপরিবারে মধ্য কলকাতার পুরনো ফ্ল্যাট ছেড়ে নিউটাউনের এই বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকা শুরু করবেন।পাত্রী অবশ্য ছেলে নিজেই পছন্দ করেছে।তার ছেলের সাথে চাকরি করে মেয়েটি,রাই ব্যানার্জি। রাইকে বেশ ভালো দেখতে। আই.টি সেক্টরে কাজের সাথে সাথে একটি এন.জি.ও র সাথে যুক্ত সে।আজ পূজার অনুষ্ঠানে সমস্ত আত্মীয়-পরিজন এবং বান্ধবীদের ফ্ল্যাট ঘুরে দেখাচ্ছেন মিসেস মুখার্জি। তিনি বলছেন তিন কামরার ফ্ল্যাটের দক্ষিণ দিকের ঘরটায় তার ছেলে এবং বৌমা থাকবে, উত্তরদিকের ঘরে নাকি মিস্টার মুখার্জি এবং তিনি থাকবেন আর একটা ঘর থাকবে গেস্টরুম হিসেবে। আজকের গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে রাইও উপস্থিত।রাই ও বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।তবে বছরখানেক আগে রাই এর বাবা মারা গ্যাছেন। রাই তার মায়ের সাথে থাকে এখন।  পুজোর কাজ রাই নিজের হাতেই করছে।শুধু মাঝে মাঝে ফোন করে বা ভিডিও কল করে জেনে নিচ্ছে  কিভাবে, কি করবে। মিসেস মুখার্জী অবশ্য  তার বান্ধবীদের কাছে ছেলের প্রশংসা করতেই ব্যস্ত।সব আত্মীয় পরিজন চলে যাবার পর মিসেস মুখার্জী গৌরবকে বললেন, "বাবাই, আসলে গৌরবকে বাবাই বলেই ডাকেন মিসেস মুখার্জী,এই দক্ষিণ দিকের ঘরে তোমরা থেকো, তাহলে উত্তর দিকের ঘরে আমি আর তোমার বাবা থাকবো।আর মাঝের ঘরটা গেস্টরুমে হিসেবে থাকবে। লোকজন এলে থাকবে।সেটাই ঠিক রইল। 
কাল থেকে এসে আমি ফ্ল্যাট গোছানোর কাজ শুরু করবো।এক মাসের মধ্যেই তো আবার তোমাদের বিয়ে।"
এরপর গৌরব সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলল "না,দক্ষিণের দিকে ঘরটায় আমরা থাকবো না।দক্ষিণের দিকের ঘরটা অন্য একজনের জন্য। উত্তর দিকে যে ঘরটা সেখানে আমরা থাকবো আর মাঝে যে ঘরটা সেটা আমাদের কাজের জন্য।বেডরুমে বসে তো সব সময় কাজ করা যায় না।তোমরা বরং মধ্য কলকাতার পুরনো ফ্ল্যাটেই থেকো। মাঝে মাঝে অবশ্যই তোমরা এসো। আমরাও মাঝে মাঝে যাব।
এবার মিসেস মুখার্জী  আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন "দক্ষিণ দিকের ঘরটা কার জন্য থাকবে?এটা কি তাহলে রাইয়ের মায়ের জন্য?মেয়ের বিয়ের পর একলা থাকতে পারবেন না বলে ফ্ল্যাটে মেয়ের সাথে থাকবেন ঠিক করেছেন।এবার রাই কিছু বলতে যাচ্ছিল গৌরব তাকে ইশারা করে চুপ করতে বলল।তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল "মা এই ঘরে কে থাকবে সেটা একটা সারপ্রাইজ। যিনি থাকবেন তিনি বিয়ের পর যেদিন আমরা প্রথমে এই বাড়িতে ঢুকবো সেই দিনই তিনি আসবেন। তুমি আমাদের সঙ্গে তাকেও বরণ করে নিও।"
মিসেস মুখার্জী আর কথা বাড়ালেন না।গৌরব বলল তোমরা এবার ফ্ল্যাটে ফিরে যাও।আমি একটু পরে ফিরব।দক্ষিণের ঘরটার জন্য একটু আলাদা করে ফার্নিচার বানাতে হবে। ফার্নিচার বানানোর জন্য লোক আসবে।আমি কাজটা বুঝিয়ে তারপর বাড়ি ফিরব। 
মিস্টার মুখার্জি এবং মিসেস মুখার্জী বেরিয়ে এলেন।গাড়িতে যেতে যেতে মিসেস মুখার্জী বললেন "বাবাই কেমন যেন একটু বদলে গেছে।কে থাকবে ফ্ল্যাটে সেটা বললেই পারতো। আর রাই এর মা থাকলেও আমরাও তো থাকতে পারতাম। তিনটে তো ঘর ছিল।এমন কিছু ছোট নয় ফ্ল্যাটটা" এবার মিস্টার মুখার্জি বললেন "সে তো আমাদের পুরনো মধ্য কলকাতার ফ্ল্যাটটাও খুব একটা ছোট ছিল না।কিন্তু তাও তো তুমি আমার মাকে….. বলে মিস্টার মুখার্জি থামলেন।এবার মিসেস মুখার্জী বললেন সে তো বাবাইয়ের একটা স্টাডিরুমে দরকার ছিল সেই জন্য। ছেলে বড় হলে তার জন্য তো একটা আলাদা ঘর লাগবেই।
" কিন্তু কারণটা কি শুধু সেটাই ছিল তপতী?"
এরপর মিসেস মুখার্জী একটু চুপ করে গেলেন।
এরপর যথাসময়ে মহাসমারোহে আড়ম্বরের সঙ্গেই গৌরবের এবং রাইয়ের বিয়ে হল।পরেরদিন বধূবরণ এর জন্য মিসেস মুখার্জী সুন্দর করে সেজেগুজে তৈরী হলেন।গাড়ি এসে থামলো ফ্ল্যাটের নীচে।নীচে নামলেন মিসেস মুখার্জী।কিন্তু গাড়ি থেকে বাবাইয়ের সাথে কে নামছেন! মিসেস মুখার্জী ভুত দেখার মত চমকে গেলেন। এ কাকে দেখছেন? বাবাই আর রাইয়ের সাথে নামছেন তার শাশুড়ি মা।বাবাই যখন ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠেছিল তখন বাবাইয়ের আলাদা একটা ঘর লাগবে, ফ্ল্যাট খুব ছোট,সেই কথা বলে তিনি শাশুড়িমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছিলেন। যদিও বাবাই বলেছিল অনেকবার যে ঠাম্মার সঙ্গে থেকে তার পড়াশোনা করতে কোন অসুবিধা হবে না। কিন্তু মিসেস মুখার্জী সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছিলেন।নাতির ভালো হবে এই ভেবে কোন প্রতিবাদ না করেই বৃদ্ধাশ্রমের চলে গিয়েছিলেন তার শাশুড়িমা।
এবার বাবাই বলল "কি হল মা বরণ করো আমাদের তিনজনকে। দক্ষিণের দিকে ঘরটায়  থাকবে আমার ঠাম্মা। যেদিন তুমি ঠাম্মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে ছিলে সেদিন প্রতিবাদ করতে পারি নি কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যেদিন আমার নিজের বাড়ি হবে সেদিন সবচেয়ে ভালো ঘরটা থাকবে আমার ঠাম্মার জন্য। আর মা তুমি কি ভেবেছিলে ঠাম্মা বৃদ্ধাশ্রমে চলে গ্যাছে বলে আমার সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না।ভুল ভেবেছিলে, মা।কলেজে পড়াকালীন আমি ঠাম্মার সাথে যোগাযোগ রাখতাম, দেখাও করতে যেতাম মাঝে মাঝে। ঠাম্মাকে একটা আলাদা করে ফোন কিনে দিয়েছিলাম।যেটার নাম্বার শুধু আমার কাছেই থাকত। তারপর রাইয়ের সাথে পরিচয় হবার পর রাই, আমি দুজনেই ঠাম্মার সাথে বৃদ্ধাশ্রমের দেখা করতে যেতাম। ঠাম্মার নামেই তো আমি এই ফ্ল্যাটের নাম রেখেছি চারুলতা।তুমি বোধহয় ভুলে গেছে মা যে ঠাম্মার নাম চারুলতা মুখার্জি।আর সেদিন গৃহপ্রবেশে রাই যে পুজোর আয়োজন করেছিল সেটা সবই ঠাম্মার নির্দেশমতো। কিন্তু সেই দিন আমি ঠাম্মাকে ফ্ল্যাটে নিয়ে আসি নি কারণ আমি চেয়েছিলাম তুমি ঠাম্মাকে বরন করে নতুন করে তাঁর ঘরে নিয়ে যাও।"
এবার চারুলতা দেবী মুখ খুললেন তিনি বললেন "বৌমা তোমরাও এই বাড়িতেই চলে এসো। আর একটা ঘর তো আছে। দাদুভাই আর রাই দিদিভাইয়ের যদি কাজের দরকার হয়, আমার ঘরে বসে না হয় করবে। যেমন ছোটবেলায় ও আমার ঘরে বসে পড়াশোনা করত। আমার কোন অসুবিধা হবে না।একটা কথা আছে জানো তো দাদুভাই
'যদি হয় সুজন 
তেতুল পাতায় নয়জন '
এরপর মিসেস মুখার্জী ছেলে,বৌমা এবং শাশুড়ি মাকে নিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে  প্রবেশ করলেন।

লেখিকাঃ______সুস্মিতা রায়চৌধুরী