কর্তব্যপরায়ণতা

আজ আসি রে মিলন। সাত তারিখ দেখা হবে স্টেশনে। তুই রেডি হয়ে কাকুকে নিয়ে চলে যাস হাওড়া স্টেশনে। আমিও শেওড়াফুলি থেকে ঠিক সময় মতো হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে যাব। এতগুলো কথা বলে সৌভদ্র ।

কর্তব্যপরায়ণতা
করতবযপরযণত, story bangla, bangla story new, read new story

কর্তব্যপরায়ণতা 

আজ আসি রে মিলন। সাত তারিখ দেখা হবে স্টেশনে। তুই রেডি হয়ে কাকুকে নিয়ে চলে যাস হাওড়া স্টেশনে। আমিও শেওড়াফুলি থেকে ঠিক সময় মতো হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে যাব।
এতগুলো কথা বলে সৌভদ্র ।
সৌভদ্র আর মিলন দুজন বাল্য বন্ধু। সেই ছোট্ট থেকে একই স্কুল কলেজে পড়াশোনা করেছে আর থাকতো একই জায়গায় মানে ভদ্রেশ্বরে। কিন্তু এখন কর্মসূত্রে মিলন থাকে কোন্নগরে আর সৌভদ্র থাকে শেওড়াফুলিতে। এখনও বন্ধুত্ব অমলিন। সবসময় হয়তো দেখা হয় না তবে যোগাযোগ ঠিকই আছে। ছোট থেকেই ওরা একই সাথে সব জায়গায় বেড়াতে যেত। আগে ওদের   নিয়ে দুই পরিবারের বাবা মায়েরা বছরে দুবার করে বেড়াতে যেত। এখন ওরা দুজনে একসাথে যায়।
 সৌভদ্র বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান কিন্তু মিলনের  একটা বোন আছে। বোন সুকন্যা আর ওর মা বাড়িতে আছেন। সৌভদ্রর বাবা আছেন কিন্তু ওর মা অনেকদিন হলো মারা গেছেন। 
এবার অবশ্য ওরা বেড়াতে যাচ্ছে না। যাচ্ছে মিলনের বাবাকে নিয়ে মুম্বইতে ডাক্তার দেখাতে।
মুম্বই যাওয়ার আগে দুই বন্ধুর কথা হয়ে গেছে।
যথা সময়ে মিলন ওর বাবা সোমেশ্বর বাবুকে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গেছে।  ট্রেন লেটে ছাড়বে তাই রাত হবে  ট্রেন ছাড়তে । সৌভদ্র এখনও হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছয় নি। মিলন বারে বারে সৌভদ্রকে ফোন করছে কিন্তু প্রথমে ফোনটা বেজে বেজে কেটে যাচ্ছিল পরে ফোন ধরে বলে, তুই ট্রেনে উঠে যা কাকুকে নিয়ে, আমি ঠিক সময়মতো উঠে যাব। আসলে জানিস তো মা, মারা যাওয়ার পর বাবা বড্ড একা হয়ে গেছেন। ওনাকে সামলে আসতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার আগেই ঠিক ট্রেনে উঠে যাব। তুই কাকুকে নিয়ে সাবধানে উঠে যা। চিন্তা নেই আমি আছি তোর সাথেই আর থাকবোও তোর সাথে সবসময়। 
যথা সময়ে ট্রেন প্লাটফর্মে চলে আসে আর মিলন ওর বাবাকে নিয়ে ওদের রিজার্ভ করা সিটে বসেও পড়ে। ট্রেন ছাড়তে আর দেরি নেই। পাঁচ মিনিট বাকি কিন্তু এখনও সৌভদ্র এলো না দেখে মিলন আবার ফোন করে সৌভদ্রকে। সৌভদ্র বলে...,
চাপ নিসনা। আমি ঠিক তোর সাথে দেখা করে নেব।
 ট্রেনটা অনেক রাত করে ছাড়ছে তাই সবাই ট্রেনে উঠেই শুয়ে পড়েছে। মিলনও ওর বাবার বিছানাটা ঠিক করে দিয়ে বাবাকে শুইয়ে দিয়েছে। নিজেও শুয়ে পড়ে আলোটা অফ করে দিয়েছে । হঠাৎ করে সৌভদ্র এসে হাজির। বলে...,
উঠতে হবে না, তুই শুয়ে থাক। আমি অনেকক্ষণ ট্রেনে উঠেছি কিন্তু  আসতে পারছিলাম না । সবাই আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ার পরই চলে এলাম। তুই ঘুমা আমি আছি। কাকুর জন্য তোকে চিন্তা করতে হবে না। রাতে আমি কাকুকে দেখে রাখব। তুই নিশ্চিন্তে ঘুমা।
মিলন বলে...,
তোর লাগেজ কোথায়? সেগুলো কোথায় রাখলি? সেগুলো নিয়ে আয়। তোর সিটের তলায় রেখে দে।
সৌভদ্র ওর কথার কোন উত্তর না দিয়ে বলে...,
তুই এখন ঘুমাতো পরে ওসব নিয়ে ভাববি ! 
মিলন সত্যি সত্যিই অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে। পরের দিন সকাল সাতটার সময় ওর বাবার ডাকে ঘুম ভাঙে। ঘুম থেকে উঠে সৌভদ্রকে দেখতে না পেয়ে ভাবে নিশ্চয়ই বাথরুমে গেছে! তাই  সৌভদ্রর কথা বাবার কাছে জানতে না চেয়ে, সোজা বাথরুমে চলে যায়।
বাথরুম থেকে ফিরে এসে সৌভদ্রকে দেখতে না পেয়ে মিলন ওর বাবার কাছে জানতে চায়...,
বাবা, সৌভদ্র কোথায়?
সোমেশ্বর বাবু বলেন...,
সৌভদ্র! কখন এলো? কই আমি তো ওকে দেখিনি!
মিলন বলে...,
কাল রাতে এসেছিল। তখন তুমি ঘুমাচ্ছিলে। কোথায় যে যায় বুঝতে পারি না। সোমেশ্বর বাবু বলেন...,
তাহলে হয়তো বাথরুমে গেছে। চলে আসবে।
অনেকক্ষণ পরেও যখন সৌভদ্র আসে না তখন মিলন ওকে আবার ফোন করে কিন্তু দেখে ফোন সুইজ অফ। মিলন একবার এদিক ওদিক ঘুরে দেখে আসে কিন্তু দেখতে পায় না। মনে মনে খুব রাগ হয় সৌভদ্রর ব্যবহারে। ঠিক করে আর একদম ফোন করবে না ওকে। মিলন আরও ভাবে, নিশ্চই দায় এড়াতে সৌভদ্র ওদের থেকে আলাদা থাকছে।মনে ভাবে সৌভদ্র তো এমন নয়। ভীষণ কর্তব্যপরায়ণ কিন্তু এখন কি হলো যে ও আমাদের এড়িয়ে যাচ্ছে! 
যথা সময়ে ওরা নেমে যায়। হঠাৎ সৌভদ্র ওদের সামনে আবার চলে আসে। মিলন রাগ করে ওর সাথে কথা বলে না। সোমেশ্বর বাবু বলেন...,
কোথায় ছিলি রে সৌভদ্র? সারা ট্রেনে একবারও তোর টিকি দেখতে পেলাম না। সৌভদ্র বলে...,
আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম কাকু। এই তো চলে এলাম। আপনাকে পৌঁছে দিয়ে ডাক্তার দেখিয়েই আমার মুক্তি। পরে বন্ধুর উদ্দেশ্যে বলে,
কি রে মিলন, আমার উপর রাগ করলি নাকি? রাগ করিস না বন্ধু। আজ আছি কাল নেই। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে কেউ কি কারুর উপর রাগ করে?  রাগ করিস না মিলন! আমি সবসময় তোর সাথে আছি আর থাকব। 
মিলন বলে...,
তুই সারা দিন কোথায় ছিলি? ফোন অফ ছিল কেন? আমি কতবার তোকে ফোন করছি!কিছু খেয়েছিস? নাকি.... 
সৌভদ্র বলে....,
আমার আর খিদে নেই রে। আসলে বাবা খুব কান্নাকাটি করছে তো তাই মনটা খুব খারাপ।
সেই রাতে ওদের রুমে পৌঁছে দিয়ে সৌভদ্র আবার কোথায় চলে যায়।যাওয়ার সময় বলে, দেখবি কাকুর কিচ্ছু হবে না। ডাক্তার ভালো কিছু বলবেন। তুই সুস্থ শরীরে কাকুকে ঠিক বাড়ি নিয়ে যাবি। চিন্তা করে মন খারাপ করিস না। আমি আসি বলেই নিমেষে চলে যায়, মিলনকে কিছু বলার সুযোগ  না দিয়েই। 
পরের দিন সকালে মিলন, সোমেশ্বর বাবুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে  যায়। আসলে  কয়েক দিন ধরে সোমেশ্বর বাবুর পেটে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। কলকাতার ডাক্তার দেখিয়েছেন, অনেক পরীক্ষা করিয়েছেন ।ডাক্তার বলছেন গ্যাসটিক আলসার থেকেই ব্যথা হচ্ছে। কলকাতার ডাক্তারের উপর ওনার বিশ্বাস নেই তাই ওনার এক আত্মীয়ের পরামর্শেই এখানে আসেন ডাঃ ঠাকুরকে দেখাতে। 
ডাক্তার ওনাকে দেখে ওনার রিপোর্ট দেখে এবং ওখানে গিয়ে আরও যেসব পরীক্ষা করা হয় তার রিপোর্ট দেখে বলেন...,
চিন্তার কিছু নেই। প্রচুর পরিমাণে জল আর সুষম খাবার ঠিক সময় মতো খেলেই সুস্থ হয়ে উঠবেন। আপনার গ্যাসট্রিক আলসার হওয়ার ফার্স্ট স্টেজ।
ডাক্তার দেখিয়ে মিলন বাড়িতে ফোন করে মা আর বোনকে সব জানায় এবং ওরা আগামী কালকের ট্রেনেই ফিরে আসছে সেটাও জানায়।
ফোন রাখার কিছু পরেই মিলনের বোন সুকন্যা আবার ফোন করে। কাঁদতে কাঁদতে মিলনকে বলে...,
তুই যে বললি, সৌভদ্রদাদা তোদের সাথে যাবে? যায় নি তো? কেন যায় নি সেটা কি জানিস?
মিলন বলে...,
কেন আসবে না! আমাদের সাথে হয়তো সবসময় ছিল না কিন্তু দেখা করে গেছে। মাঝে মাঝে এসে আমাদের কোনও দরকার আছে কিনা জেনে গেছে।
সুকন্যা বলে...,
সেটা কি করে সম্ভব? তোরা যেদিন ট্রেনে উঠেছিস সেদিন সৌভদ্রদাদা শেওড়াফুলি থেকে চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়ে পা ফসকে পড়ে যায় এবং ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যায়। 
আজ একটু আগেই ওদের পাড়ার  টুকাইদা আমাদের ল্যান্ড ফোনে ফোন করেছিল । আসলে তুই সৌভদ্রদাদার প্রিয় বন্ধু কিন্তু দেহ সৎকারের কাজে তোকে দেখতে পায় নি। কেন সেটা জানতেই ফোন করেছিল। সুকন্যা হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে আর মিলনের হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। শরীরটা অবশ লাগে।কান্না গলার কাছে ডেলা পাকিয়ে থাকে।
হঠাৎ বাবার ডাকে সম্বিৎ ফেরে ।সৌভদ্র বলে,চিৎকার করে কেঁদে ওঠে মিলন। বলে, তোকে ভুল বুঝেছিলাম। তুই কর্তব্যপরায়ণ আমি জানতাম। সেটা জেনেও কেন তোকে ভুল বুঝলাম! আমাকে ক্ষমা করে দে বন্ধু। তুই ছাড়া আমি যে অন্ধ। কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলি?
বাড়ি ফিরেই মিলন চলে যায় সৌভদ্রদের বাড়ি। এখন যে ওর অনেক দায়িত্ব। সৌভদ্র নেই। ওর বাবা দীপক কাকুর দায়িত্ব যে ওকেই নিতে হবে । প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে যে ওনার ছেলে হয়ে ওনাকে দেখাশোনা করে । তবেই যদি সৌভদ্রের আত্মা শান্তি পায়।


লেখিকাঃ ___দেবিকা_মিত্র