অনন্যা জুয়েলার্স (গল্প )
কি গো গিন্নি, হলো তোমার আর কতক্ষণ লাগবে বলো তো? সমরবাবু বেশ ব্যস্ত হয়ে বললেন।

অনন্যা জুয়েলার্স (গল্প )
----কি গো গিন্নি, হলো তোমার আর কতক্ষণ লাগবে বলো তো? সমরবাবু বেশ ব্যস্ত হয়ে বললেন।
------- অত ব্যস্ত হচ্ছো কেন? এইজন্য আমি যাব না বলেছিলাম...বললাম , তুমি একাই যাও । এ কি বিয়ে বাড়ি নাকি, যে গিয়ে তাড়াতাড়ি পাত পেড়ে খেয়ে ফিরতে হবে! যাচ্ছ তো নববর্ষের হালখাতার নিমন্ত্রণে, তার জন্য আবার এত ব্যস্ততা কেন? অনিতা দেবী ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে বললেন।
------ আরে গিন্নি, বিয়ে বাড়িতেই বা এখন কোথায় পাত পেরে খাওয়ানো হয়? সেই তো প্লেট নিয়ে গিয়ে নিজেই খাবার নিয়ে এসো, তারপর বসতে পেলে ভালো, তা না হলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খেতে হয়। গৃহকর্তা তো জানতেই পারেন না, কে খেলো, কি খেলো, আর কে খেলো না। এখানে তো তবু অখিলবাবু এবং অনন্যা নিজে আমন্ত্রিতদের অভ্যর্থনা করে,কথা বলেন।
------- তা অবশ্য ঠিক। চলো আমার হয়ে গ্যাছে।
------ আসলে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি, কারণ একেবারে তোমার ছোট মেয়ে, বুল্টির বিয়ের গয়নাগুলো একটু পছন্দ করে আসবে। তুমি তো আবার বাতের ব্যথার জন্য বেশী বেরোতেই পারো না । যেদিন ওরা কার্ড দিয়ে হালখাতার জন্য নিমন্ত্রণ করে গেল সেই দিন থেকেই ভেবে রেখেছিলাম। সময় তো আর বেশি নেই। একমাস পরেই তো বিয়ের দিন।
যখন থেকে এই অনন্যা জুয়েলার্স তৈরি হয়েছে প্রতিবছর কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ করে। সমরবাবু বড় মেয়ের গহনাও নিয়েছেন এই দোকান থেকেই। শ্বশুরবাড়িতে সেই গহনার ডিজাইনের প্রশংসাও হয়েছে খুব।
--------- ধ্যুর! তুমি কি যে বলো, আজ এত ব্যস্ততার মধ্যে গহনা দেখা সম্ভব নাকি?
-------- সে অনন্যাকে বললেই ও ঠিক ব্যবস্থা করে দেবে।মেয়েটা সত্যিই খুব ভালো।
অনিতা দেবী এবং সমরবাবু দুজনে রওনা দিলেন অনন্যা জুয়েলার্সের উদ্দেশ্যে।
সমরবাবু যেতে-যেতে ভাবছিলেন,পাড়ার মোড়ে একটা ছোট্ট সোনার দোকান ছিল অখিল বাবুর। মেয়ের নামে দোকানের নাম রেখেছিলেন অনন্যা জুয়েলার্স। একটিই মেয়ে ওনার। সমরবাবু দেখতেন খুব ছোটবেলা থেকেই অনন্যা দোকানে আসত, বসে থাকতো অখিলবাবুর পাশে। পড়াশোনাতেও নেহাৎ মন্দ ছিল না মেয়েটি। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে জুয়েলারি ডিজাইনিং এর কোর্স করে পুরোপুরি দোকানের দায়িত্ব নিলো সে। অনন্যা নিজে গহনার ডিজাইন করে। দিনের বেশিরভাগ সময়টাই সে দোকানেই থাকে। ক্রেতাদের সঙ্গে বড় অমায়িক ব্যবহার করে মেয়েটি। সোনা বিক্রির সাথে সাথে ক্রেতাদের বিশ্বাসও অর্জন করে নেয় অনন্যা। আর ঠিক সেই জন্যই পাড়ার মোড়ের সেই ছোট্ট দোকান হয়ে উঠেছে আজ একটা ঝাঁ-চকচকে শোরুম। বসেছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র। বালা, চুরি, নেকলেস, আংটি, সবকিছুর জন্যই আলাদা আলাদা বিভাগ। অনন্যা নিজে সাহায্য করে ক্রেতাদের গহনা পছন্দ করতে। বেশ কিছু মেয়েকেও কাজে নিযুক্ত করেছে সে। তবে এটাও ঠিক যে দোকানের শ্রীবৃদ্ধির সাথে সাথে গহনা তৈরির খরচও বেড়েছে বেশ অনেকটা।
এইসব চিন্তা করতে করতে সমরবাবু পৌঁছে গেলেন অনন্যা জুয়েলার্সে। খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে দোকানটা। শোরুমের সামনেই দেখা হল অখিলবাবু এবং অনন্যার সাথে। অনন্যা তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসলো "আসুন আসুন কাকাবাবু ,ভেতরে চলুন। আপনারা এসেছেন খুব ভালো লাগছে! সমরবাবু দেখলেন আমন্ত্রিত সংখ্যা অনেক,তবু অনন্যার নজর প্রায় প্রত্যেকের দিকেই। পুরো শোরুমের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত দৌড়চ্ছে প্রায়। হলুদ রঙের শাড়ী আর হালকা সোনার গয়নাতে,খুব সুন্দর লাগছে আজ অনন্যাকে।
অনন্যা কাছে আসতেই অনিতাদেবী জিজ্ঞাসা করলেন "তুমি যে জুয়েলারিগুলো পড়েছ, সব তোমার নিজের ডিজাইন?"
"হ্যাঁ..,কাকিমা সব আমার নিজের ডিজাইন। এই দোকানের বেশিরভাগ গয়নার ডিজাইন আমারই তৈরি। তবে সব নিশ্চয়ই নয়।"
এবার সমরবাবু বললেন "আসলে তোমার কাকিমাকে নিয়ে এসেছি একটা উদ্দেশ্যে। আজ একটু বিয়ের গহনা দেখে পছন্দ করে যাব। বুল্টির বিয়ে ঠিক হয়েছে পরের মাসে। কিন্তু আজ সম্ভব হবে কিনা বুঝতে পারছি না?"
অনন্যা সঙ্গে সঙ্গে বলল "সে তো খুব ভালো খবর কাকাবাবু। হবে না কেন! আমার দোকানের কর্মীরাতো আছে। আপনারা দেখুন, পছন্দ করুন। পছন্দ হয়ে যাবার পর আমি যাচ্ছি, গিয়ে দেখবো।"
সমর বাবু বরাবরই মেয়েদের গহনা পরা পছন্দ করেন। নিজেই পছন্দ করলেন ছোট মেয়ের জন্য গহনা। তারপর অনন্যা কাছে আসতেই বললেন "দেখতো কেমন পছন্দ করেছি। আমি আজকে কিছু টাকা জমা করে যাচ্ছি।"
অনন্যা বলল "খুব ভালো পছন্দ করেছেন কাকাবাবু। বুল্টির খুব পছন্দ হবে। আপনি আমাকে বুল্টির নাম্বারটা দিন আমি বরং ওকে হোয়াটসঅ্যাপে গয়নাগুলো ছবি পাঠিয়ে দেব। যদি কিছু পরিবর্তন করতে হয় ওকে বলবেন আমাকে ফোন করতে ।"
"আমি এখনই দিচ্ছি ফোন নাম্বার" সমরবাবু বললেন।
এরপর অনন্যা বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন "কাকিমা আপনার বাপের বাড়িতো বর্ধমানে, এই বছরের শেষের দিকে বর্ধমানে একটা ব্রাঞ্চ ওপেন হবে আমাদের।"
সমরবাবু বললেন "বাহ! খুব ভালো খবর তোমার সাফল্য দেখে সত্যিই খুব আনন্দ হয়।"
"আনন্দ তো হয় ভাই। তবে মেয়ে নিজের দিকে লক্ষ্য করার সময়ই তো পায় না। পুরো দিন থাকে দোকানে , তারপর রাত জেগে গয়নার ডিজাইন তৈরি করে। ছোট থেকেই সোনা ওর বড্ড প্রিয়।" অখিলবাবু বললেন।
"কষ্ট না করলে তো কেষ্ট পাওয়া যায় না দাদা। যখন চাকরি করতাম তখন আমার অবাঙালি বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলতো বাঙালি ব্যবসা করতে পারে না। বাঙালিরা কুড়ে। অলস প্রকৃতির। সারাদিন শুধু ফ্যানের তলায় বসে টেবিল-চেয়ারে কাজ করবে। আর যারা চাকরি পায় না তারাই শুধু ব্যবসা করে। কিন্তু এই যে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ব্যবসাটাকে এত পজেটিভলি নিয়ে সুন্দর ভাবে চিন্তা ভাবনা করে এগিয়ে যাচ্ছে, এটা দেখেই খুব ভালো লাগে। তুমি আরো এগিয়ে যাও মা।"
এই বলে গহনার জন্য কিছু টাকা জমা করে, দুটো বড় মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলেন সমরবাবু এবং অনিতাদেবী।
ফেরার পথে অনিতাদেবী বলতে লাগলেন "সবই ভালো,মেয়েটাও খুব ভালো। কিন্তু এখনো বিয়ে হলো না। বিয়ের বয়স তো হয়েছে। শুনেছি নাকি অনন্যা বলেছে এমন ছেলেকে বিয়ে করবে যে ওর ব্যবসার কাজে কখনো বাধা দেবে না এবং ওর সঙ্গে ওদের বাড়িতে এসে থাকবে। কারণ ও দোকানের কাছাকাছি থাকতে চায়। কিন্তু এখন অব্দি তো তেমন ছেলে পাওয়া গেলো না। এখন না হয় মা-বাবা আছে কোনো অসুবিধে নেই। কিন্তু মা বাবা যখন থাকবেনা তখন ওকে দেখবে কে, সেটাও তো ভাবা উচিত।
"তোমার কি মনে হয় গিন্নি, যে মেয়েটা এত বড় একটা দোকান সামলাচ্ছে, এতগুলো মেয়ের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে তাকে দেখার জন্য সত্যিই কি কাউকে প্রয়োজন? তবে হ্যাঁ, ভালোবেসে কেউ পাশে থাকলে সে তো বড়ই আনন্দের কথা। কিন্তু বিয়েটা যেন কখনোই ওর এই সাফল্যের পথে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায় সেটাই আমি মনে মনে চাইব। তবে এমন একটা মেয়ের জন্য ভালো ছেলে নিশ্চয়ই আসবে ওর পাশে থাকার জন্য.. এটা আমার বিশ্বাস।"
এর পরেই ঘটল একটা অঘটন।এর ঠিক এক সপ্তাহ পরেই হঠাৎ স্ট্রোক হল সমরবাবুর।কলকাতার বড় নার্সিংহোমে সমরবাবুকে ভর্তি করালেন সকলে। কিন্তু অনেক চিকিৎসার পরও বাঁচানো গেল না। উনি মারা গেলেন।
এই অবস্থায় বুল্টির বিয়েও নির্দিষ্ট দিন থেকে পিছিয়ে গেল কয়েক মাস পর। আর্থিক অবস্থার বেশ অবনতি ঘটল স্বাভাবিকভাবেই। পেনশনের টাকা অর্ধেক হয়ে গেল। সঞ্চিত অর্থের অনেকটাই খরচ হয়ে গেছে সমরবাবুর চিকিৎসায়। সমরবাবুর বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে দিল্লিতে আর ছোট মেয়ে বুল্টি সবে এম.এ পরীক্ষা দিয়েছে। এখনো চাকরী করে না।
এই অবস্থায় অনিতাদেবী ঠিক করলেন বিয়ের খরচ কিছুটা কমিয়ে দেবেন। অত বড় দোকান অনন্যা জুয়েলার্সের গয়না না নিয়ে একটা ছোট দোকান থেকে নেবেন। তাতে হয়তো গহনার মজুরি কিছুটা কম হবে। যেটুকু টাকা জমা দেওয়া আছে, সেই টাকা দিয়ে না হয় জামাইয়ের জন্য একটা আংটি কিনে নেবেন। এমনই মনস্থ করে অনিতা দেবী গেলেন অনন্যা জুয়েলার্স। গিয়ে বললেন সব কথা।
সব শুনে অনিতা দেবীর হাতটা ধরে অনন্যা বলল "কাকিমা বুল্টির বাবা নেই... মানে কাকু নেই ঠিকই কিন্তু এই দিদি তো আছে। মারা যাবার আগে কাকু যে গহনা বুল্টির জন্য পছন্দ করে গেছিলেন..., বুল্টি তাঁর বিয়ের জন্য যে গয়না দেখেছিল, সেই গয়না পরেই বুল্টির বিয়ে হবে। গয়নার মজুরি আমি অর্ধেক করে দিলাম। আপনার ছোট দোকানের থেকেও কম করে দিলাম। আর সোনার দাম তো সব জায়গাতেই এক। আপনাকে বেশি চিন্তা করতে হবে না কাকিমা। আপনি যখন পারবেন, যেমনভাবে পারবেন , তেমনভাবেই টাকা দেবেন ! আমি আপনাকে টাকার জন্য কখনো জোর করব না। কিন্তু বুল্টির বিয়ের গয়না আমাদের দোকান থেকেই যাবে , এটা আমার অনুরোধ কাকিমা! আপনাকে আসতে হবে না, আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসব।
এরপর আর কোন কথা বলতে পারলেন না অনিতা দেবী। অবাক হয়ে, মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন অনন্যার দিকে। মেয়েটি সত্যিই সার্থকনামা। ও শুধু সোনার গয়নার ডিজাইন ভালো করে না, ওর মনটা সোনার চেয়েও দামি।
এবার অনিতাদেবী বললেন "তাহলে তুমি বোনের বিয়েতেও দিদি হিসেবে এসো, আশীর্বাদ করতে!"
তবে বিয়ের তারিখটা শুনে অনন্যা একটু হেসে বলল " কাকিমা ওইদিন তো আমি যেতে পারব না!"
"কেন!" অনিতাদেবী জিজ্ঞাসা করলেন।
এবার পেছন থেকে অখিলবাবু এগিয়ে এসে বললেন " এইদিন যে ওর ও বিয়ে! হঠাৎ করেই ঠিক হয়ে গেল। আমাদের দোকানের ট্যাক্স ফাইলিং-এর কাজ করতো যে চাটার্ড ফার্ম, সেই ফার্মের মালিকের সাথেই অনন্যার বিয়ে। কাজের সূত্রে পরিচয় হয়েছিল দুজনের। অনন্যার ব্যবসার কাজের ব্যাপারে ছেলেটির খুব উৎসাহ এবং ওদের বিয়ের পর আমাদের বাড়িতে এসে থাকার ব্যাপারেও ওর কোন আপত্তি নেই।"
"বাহ ! এতো খুব ভালো খবর। আশীর্বাদ করি অনন্যা , তুমি জীবনে সুখী হও ভালো থাকো।" অনিতাদেবী বললেন।
ফেরার পথে অনিতাদেবী ভাবছেন
সমরবাবুর কথাটা সম্পূর্ণ মিলে গেলো। সমরবাবু বলেছিলেন "এমন একটা ভালো মেয়ের পাশে থাকার জন্য একটা ভালো ছেলে নিশ্চয়ই আসবে।"
আজ রবি ঠাকুরের গানের কয়েকটি লাইন বড় মনে পড়ছে অনিতা দেবীর
"আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে
তবুও শান্তি, তবুও আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।।"